সাইফুল ইসলাম, মানিকগঞ্জ: মানিকগঞ্জ জেলা শহরের দক্ষিণ সেওতা এলাকার ষ্টেডিয়াম রোডের চাঞ্চল্যকর মাহমুদা আক্তার (৪৫) হত্যা মামলায় দুই জনের মৃত্যুদন্ড, দুই জনের যাবজ্জীবন ও একজনকে খালাস দিয়েছে আদালত।
বুধবার সকাল ১১ টায় মানিকগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক জয়শ্রী সমদ্দার আসামীদের উপস্থিতিতে এই রায় দেন।
গৃহিনী মাহমুদা আক্তারকে শ্বাসরোধ করে হত্যার অভিযোগে মেয়েসহ মোট ৫ জনকে আসামী করে মানিকগঞ্জ সদর থানায় মামলা করেন মাহমুদা আক্তারের স্বামী জহিরুল ইসলাম।
স্ত্রী’কে হত্যার অভিযোগে স্বামীর দায়েরকৃত মামলার আসামীরা হলেন, ঢাকার দক্ষিণ কেরাণীগঞ্জ জিন্দাপীড় এলাকার মোঃ শফিউর রহমান নাঈম (২৫), একই এলাকার আব্দুল বারেকের ছেলে মোঃ রাকিব হোসেন (২৪), অভিযোগকারীর কন্যা জুলেখা আক্তার জ্যোতি (১৯), নীলফামারী জেলার জলঢাকা উপজেলার পূর্ব গোলমন্ডা এলাকার মোঃ মাহফুজার রহমান (২০) এবং একই এলকার আব্দুল ভাসানীর ছেলে নুর বক্স।
এদের মধ্যে আসামী রাকিব ও মাহফুজার রহমানকে মৃত্যুদন্ড, নাঈম ও জ্যোতিকে যাবজ্জীবন এবং নূর হোসেনকে খালাস দিয়েছে আদালত।
মামলার এজাহার সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, ২০২০ সালের ২২ জানুয়ারী ভোর সাড়ে ৬ টার দিকে মামলার বাদী হাটার জন্য ও বাজার করার জন্য বাড়ির বাইরে যায়। এসময় পরে সকাল পৌণে ৮ টার দিকে বাজার করে বাসায় ফেরৎ আসলে মেয়ে জ্যোতি বাড়ির গেট খুলে দেন। এরপর মেয়েকে তার মায়ের সম্পর্কে জিজ্ঞিসাবাদ করিলে মা নাস্তা তৈরি করছে বলে জানান মেয়ে জ্যোতি।
এরপর বাড়ির ৫ম তলায় পোষা কবুতরের খাবার দিতে যান বাদী জহিরুল ইসলাম।সেখান থেকে ফিরে রুমের সামনে জ্যোতিকে কান্না করতে দেখে কান্নার কারণ জানতে চান তিনি। এসময় জ্যোতি এলোমেলো কথাবার্তা বললে ঘুমানোর কক্ষে গিয়ে স্ত্রী মাহমুদাকে লেপ দিয়ে ডাকা অবস্থায় দেখতে পান বাদী। ডাকাডাকিতে স্ত্রী ঘুম থেকে সাড়া না দিলে লেপ ধরে টান দিয়ে স্ত্রী’র জিহ্বা বাহির করা ও নাকে রক্ত দেখতে পান মামলার বাদী।
এসময় তার আর্তচিৎকারে আশেপাশের রুমের ভাড়াটিয়ারা চলে আসেন এবং মাহমুদাকে উদ্ধার করে মানিকগঞ্জ জেলা হাসপাতালে নেওয়া হলে কতর্ব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষনা করেন।
২০২০ সালের ৩১ মে মানিকগঞ্জ সদর থানার এসআই মোঃ শামীম আল মামুন সংশ্লিষ্ট আদালতে হত্যা মামলায় জড়িত থাকার দায়ে ৫ জন আসামীর বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। মামলায় মোট ২৫ জন সাক্ষীর মধ্যে ২১ জন ব্যক্তি সাক্ষ্য প্রদাণ করেন। পরে মামলার যুক্তিতর্ক শুনানী শেষে মানিকগঞ্জের জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক জয়শ্রী সমদ্দার রায় ঘোষণা করেন।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা তাহার তদন্তে উল্লেখ করেন, জুলেখা আক্তার জ্যোতি একটু জেদী ও বেপরোয়া হওয়ায় ঘটনার প্রায় তিন বছর আগে ঢাকার ধামরাই উপজেলার গোলাকান্দা গ্রামের মারুফের সঙ্গে পারিবারিকভাবে বিয়ে দেন। বিয়ের দুই বছর পর ঢাকার কেরাণীগঞ্জের নাঈমের সঙ্গে ফেসবুকে তার প্রেম হয় এবং এক পর্যায়ে তারা শারীরিক সর্ম্পকে জড়িয়ে যায়।এরপর ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে জ্যোতির স্বামীর সঙ্গে ডিভোর্স হলে জ্যোতি মানিকগঞ্জে বাবার বাড়ি চলে আসে।
এরপর নাঈম মাঝে মাঝে জ্যোতির সঙ্গে ওই বাড়িতে অবৈধ মেলামেশা করলে জ্যোতির মা বিষয়টি বুঝতে পারে এবং জ্যোতিকে শাষন করে দ্রুত সময়ের মধ্যে জ্যোতিকে অনত্র বিয়ে দেওয়ার জন মনস্থির করলে জ্যোতি নাঈমের সহায়তা নিয়ে তার মাকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করেন।
সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রেমিক নাঈম অপরাপর আসামীদের সঙ্গে এক লক্ষ ৫০ হাজার টাকার বিনিময়ে মাহমুদা আক্তারকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। সেই মোতাবেক ঘটনার পূর্বদিন বিকেলে জ্যোতির কক্ষে গিয়ে অবস্থান করে নাঈমসহ মোট চারজন এবং সারারাত একই কক্ষে জ্যোতিসহ সকলেই অবস্থান করেন। ঘটনার দিন সকালে জ্যোতির বাবা হাটতে ও বাজার করতে বের হলে সকল আসামীরা জ্যোতির মায়ের কক্ষে গিয়ে দেখে তিনি সেলাই মেশিনে কাজ করছেন।
জ্যোতির সঙ্গে অপরিচিত লোকদের দেখে তিনি চিৎকার করার চেষ্টা করলে জ্যোতি দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে এবং সকল আসামীরা জ্যোতির মাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে মরদেহটি খাটের উপরে রেখে লেপ দিয়ে ঢেকে রেখে কৌশলে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে পালিয়ে যায় বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করেন তদন্ত কর্মকর্তা।
মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে মানিকগঞ্জ জজ কোর্টের পাবলিক প্রসিকিউটর আইনজীবী আবদুস সালাম বলেন, চাঞ্চল্যকর এই হত্যা মামলায় জড়িত আসামীদের মৃত্যুদন্ড ও যাবজ্জীবন কারাদন্ডের রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন।
আসামী নুর বক্স এর পক্ষের আইনজীবী আইনজীবী আমিনুল হক আকবর ও খন্দকার সুজন হোসেন বলেন বলেন, এই আসামী উপরোক্ত মামলার সহিত জড়িত নহে। বিষয়টি সাক্ষ্য, জেরা এবং যুক্তিতর্কের সময় তুলে আনা হয়েছে। সমস্ত বিষয় শেষে বিচারক নুর হোসেনকে খালাস প্রদান করেন। কাজেই আমরা এই রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করছি।
তবে রায়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে উচ্চ আদালতে যাওয়ার অভিমত ব্যক্ত করেন অপরাপর আসামী পক্ষের আইনজীবীরা।